Wednesday, September 13, 2017

লাশ্রীতাসু এর অল্প জীবনের গল্প

ফুটফুটে ছোট্ট ছেলেটির দিন কেটে যায় ধূলাবালির সাথে খেলা করে।কিছুটা গম্ভীরমনা।বেশিক্ষণ নিরব থাকতেই পছন্দ করে।হৈচৈ তার একেবারেই ভাল লাগেনা।তবে হ্যা তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের জিনিসটি হল গান।একটি স্টীলের থালা হাতে নিয়ে এর মধ্যে আঙ্গুল ঠুকে আর গলা ছেড়ে গান গায়। কেউ তার গান শুনলেই বলে উঠে, ---"এক বেলা পেট ভরে ভাত খাওয়ামু,তুই একটা গান শুনারে।" ছেলটি গান গায়, ---"সোঁয়াচান পাখি আমার সোঁয়াচান পাখি........." গানের অর্থ না বুঝলেও এটি সে তার বাবার টেপ রেকর্ডার থেকে শিখেছে। খুব ভাল গায় ও।বাবা শ্রমিক।দিন আনে দিন খায়।সারাদিনে যা রোজগার হয় তা দিয়েই সংসার চলে।পরিবারের লোক সংখ্যা ৭ জন থেকে বেড়েই চলছে..... নাম 'লা শ্রী তা সু। দরিদ্র পরিবার নিয়ে বাবা মা হতাশাগ্রস্থ।ঐ ছেলেটিই হচ্ছে পরিবারের বড় ছেলে।কিন্তু ভারী কোন কাজ করতে পারেনা সে।পানির দিন আসলেই তার বাবা মাছ ধরে।পাশাপাশি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের পাহাড় থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে।তাও আবার লুকিয়ে লুকিয়ে।মাঝে মধ্যে মাছ বা খড়ির আঁটি দিয়ে লাশ্রীতাসুকে বাজারে পাঠানো হয় বিক্রি করার জন্য।তাকে যত টাকা বিক্রি করার জন্য বলা হয় তত টাকা ছাড়া অন্য কোন দামে সে বিক্রি করেনা।আসল কথা হল লাশ্রীতাসু হিসাব নিকাশে খুব কাঁচা।তাই সবাই তাকে নিয়ে মজা করে।গ্রামের ভাষায় 'ব্যাক্কল'বলেও ডাকে তাকে।এভাবে ধীরে ধীরে দিন কাটতে লাগল তার। একদিন লাশ্রীতাসু দেখল,গ্রামের সকল ছেলে মেয়েরা পাহাড় থেকে পাথর আনতে যায়।এক বস্তা পাথরের দাম ১০-১৫ টাকা।সেও তাদের সাথে গিয়ে খুব কষ্ট করে তিন বস্তা পাথর জমা করে ফেলল। খুব খুশি।এখন লাশ্রীতাসু একটু বুৃঝে।টাকা পেলে বাবা মা খুশি হবে এতে সেও আনন্দিত।ঐ সময়ে চালের দর ১৫ টাকা দর।সে এটা বুঝতে পারলো যে,দৈনিক তিনটা বস্তা পাথর দিয়ে ভরা মানে ৩-৪ কেজি চাল ক্রয় করা।এতে খাবারের অভাব কিছুটা হলেও ঘুচবে। কয়েকদিন পরেই পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হল তাদের এলাকায়।ঘরবাড়ি ডুবে গেল তাদের।তারা সবাই চলে গেল লাশ্রীতাসু এর নানার বাড়িতে অন্য গ্রামে।নানা বেঁচে নেই।নানী আছে। যাইহোক,সেখানেও বন্যা হানা দিল।শুধু ভিটেখানা বেঁচে আছে।উঠানে উরুপানি।সেইদিন ঘটল তার জীবনে একটি ঘটনা। পাহাড়ি ঢলে কয়লা নেমে এসেছে নদী দিয়ে।এগুলো ধরতে বাড়ির সবাই চলে গেল।বাড়িতে রয়ে গেল লাশ্রীতাসু,তার ছোট ভাই ও ছোট মামা আমির হোসেন। লাশ্রীতাসুতো একটু ব্যাক্কল টাইপের ছিল,তাই তার মামা তাকে কথায় কথায় ধমক আর থাপ্পর ছাড়া কোন কথা বলেনা।আসলে সে হল পরিবারের অবহেলিত একটি ছেলে।তো ঐদিন তার ছোট ভাই ও তার মামা তাকে মারল।৪ টি কলা তারা দুইজনেই ভাগ করে খেয়ে ফেলল।লাশ্রীতাসুকে দিলইনা।বরং অর্ধচন্দ্র দিয়ে তাকে বৃষ্টির মধ্যে ঘর থেকে বের করে দিল।কোমর সমান পানি। বাধ্য হয়ে তাকে বের হয়ে যেতে হল। বেরুতে বেরুতে সে হঠাৎ দেখতে পেল পুকুরের পাড় উপচে পড়া বন্যার পানিতে তেলাপিয়া মাছ শিম গাছে বেড়া দেয়া কারেন্টের জালের মধ্যে আটকা পড়েছে।তাড়াতাড়ি সে বড় মাছটি ধরে ফেলল আর ভাবল,এ মাছটি নিয়ে তার মামার কাছে দিলে হয়তো তাকে আদর করে ঘরে নেবে।বুক ভরা আশা নিয়ে মামার কাছে মাছটি দিল।সেটি নিয়ে তার মামা নিজ হাতে রান্না করে লাশ্রীতাসুর ছোট ভাইকে নিয়ে মাটিতে খেতে বসল আর মাছ খেয়ে তার কাটাগুলো মেঝের উপর রেখে বলল, --"নে তুই এগুলো খা।" লাশ্রীতাসুর বুক ফেটে কান্না আসল। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই তার।অসহায়ের মত বসে কিছুক্ষণ কেঁদে নিল। বন্যা শেষ প্রাই।তবে তারা এখনো নিজেদের গ্রামে যায়নি।লাশ্রীতাসু মাঝেমধ্যে তাদের গ্রামে আসা যাওয়া করে।তার এক ফুফু ও চাচাতো ছোট বোন ২য় শ্রেণীতে লেখা পড়া করে।তাদের পাশে বসে মনযোগ সহকারে ওদের পড়া শুণে।এভাবে সে অনেক কিছু শিখে ফেলল তাদের কাছ থেকে।মাঝে মধ্যে ওদের মত করে বানানও করে ফেলতে পারে লাশ্রীতাসু।ওরাতো অবাক! ---"কিরে,তুই বানান করতে পারিস!ভর্তি হয়ে যানা আমাদের সাথে।" এ কথা শুনে তার আগ্রহ বেড়ে গেল। লাশ্রীতাসু এই কথা বড় মামার সামনে তার বাবা মায়ের কাছে বলল। ---"লেহাপড়া করলে অনেক টেহা লাগে..." বলে দুয়েক কথা শুনিয়ে দিল তার বাবা। মামা বলল, ----"যার কপালে দু'বেলা ভাত জোটেনা তার নাকি আবার লেখাপড়া! যা কালকে থাইকা কয়লার ঠেলা গাড়ির পিছনে ঠেলতে যাইবি এতে কিছু টাকা মিলবো বাপ মায়ের অভাব দূর করবি।" মন খারাপ করে চলে গেল।কোন দূরন্তপনা নেই তার মনে।দুশ্চিন্তায় একা নিড়িবিলিতে বসে আছে সে। মা এসে বলল, --"সত্যিই লেখা-পড়া করবি?" ---"হ্যা", কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জবাব দিল লাশ্রীতাসু।
পরের দিন তার মা লাশ্রীতাসুকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসল।শিক্ষকরা তার মেধা দেখে প্রথমই তাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দিল।শুরু হল লাশ্রীতাসু এর শিক্ষা জীবণ(২০০৭)। লাশ্রীতাসু এখন আনন্দে আত্মহারা।সে ৮ টাকা ফি দিয়ে বই নিয়ে নিল।নিয়মিত স্কুলে যায়। বাড়িতে কেউ তাকে পড়তে বসার জন্য তাগাদা দেয়না।আর দেবেই বা কেন।কেউতো শিক্ষিত নয়।শিক্ষার গুরুত্বও যেন তাদের কাছে আসারে গল্প। আনন্দ আর আগ্রহের সাথে লেখা পড়া করে লাশ্রীতাসু।শিক্ষকদের ও খুব সম্মান করে।শিক্ষকরাও তাকে আদর স্নেহ করে। মক্তবে সে আরবী শিখে।কিন্তু মক্তবে তার তেমন পড়া হয়না।প্রতিদিন আরবী পড়ার জন্য বাবা ও মায়ের হাতের পিটুনী খেতে হয়।কিন্তু পরবর্তীতে লাশ্রীতাসু সহি কুরআন প্রশিক্ষণে সনদ লাভ করেছে। এতটি বছর কেটে গেল তার এভাবেই। পরের বছর লাশ্রীতাসু তৃতীয় শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে উত্বীর্ণ হল (২০০৮)। তাকে ফ্রিতে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিলো প্রধান শিক্ষক।তারপর চতুর্থ শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করল (২০০৯)। এখান থেকেই সে চিন্তাশীল হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে সে কবিতা লিখে।তার নিজস্ব প্রচেষ্টায় লিখেও ফেলল কয়েকটি কবিতা।তার কয়েকটি লাইন হচ্ছে এরকম; "সত্য ছাড়া চলবোনা মিথ্যা কথা বলবোনা সত্যের পথে চলবো সত্যের জয় করবো। সত্য কাউকে মাথা নত করেনা সত্য কাউকে ভয় করে চলেনা" লাশ্রীতাসু এর প্রিয় খেলা দাড়িয়াবান্দা ও গোল্লারছুট।এছাড়া সে অন্য কোন খেলা খেলতে পারেনা। অন্য ছেলেদের থেকে সে একটু অন্যরকম থাকতে চায় ও হতেও চায়।বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খালি গলায় ইসলামী গান ও ক্বেরাত প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম হয়।এতে সে আরও অনুপ্রেরণা পায়। ৫ম শ্রেণীতে লাশ্রীতাসু প্রথমস্থান অধিকার করলো(২০১০)। গ্রামের সেই হাবাগোবা ছেলেটি হয়ে উঠল মেধাবী।এখন তাকে পুরু এলাকার মানুষ এক নামেই চিনে।সবাই তাকে আগ্রহ অনুপ্রেরণা দেয়।তার সুন্দর আচরণ তাকে আরও প্রিয় করে দিল সবার কাছে।বড়রা তাকে স্নেহ করে।ছোটরা করে সম্মান।নেতৃ্ত্ব দানের গুণাবলী তার মাঝে ফুটে উঠতে লাগলো।পুরু স্কুলের ক্যাপ্টিনের দায়িত্ব পেল সে। সকাল ৭ টায় চলে আসে স্কুলে।প্রাইভেট বা কোচিং ক্লাসসহ বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ সমাপ্ত করে বিকাল ৪:৩০ মিনিটে বাড়ি ফিরে।লেখা পড়ায় সে একটু বেশি মনযোগ দিলো।কারণ,তাকে সমাপনী পরীক্ষা দিতে হবে।৪৬ জন ছাত্র/ছাত্রীর মধ্যে তাকে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়ায় তার প্রিয় শিক্ষক যোবায়ের স্যার।স্যার খুব আদর করে ওকে।পড়ন্ত এক বিকেলবেলা যোবায়ের স্যার লাশ্রীতাসু এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ---"দেখ বাবা,আমি সবাইকে প্রাইভেট পড়াচ্ছি।তবে তুমাকে নিয়ে আমি বড় আশা করি।আমার মুখ রাখতে পারবাতো?" ---"স্যার,আপনি শুধু দোয়া করবেন।সকল প্রচেষ্টা আমার।", লাশ্রীতাসু জবাব দিল। পরীক্ষা নিকটবর্তী হয়ে এল।নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা দিয়েও দিলো।পরীক্ষার দিনগুলো তার আনন্দেই কেটেছিল।তিন মাস পরে তার রেজাল্ট বের হল। পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হল লাশ্রীতাসু।স্কলারশিপ বৃত্তিও পেল সে।সবার মুখ সে উজ্জ্বল করে দিলো। তার পিতামাতাও আনন্দিত।কিন্তু সমস্যা হল ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে হলে ৬৮০ টাকার প্রয়োজন।৬০০ টাকা অর্জন করলে তার পিতার লাগে দুইদিন।আর দুইদিনের অর্জিত টাকা ছেলেকে দিয়ে দিলে চলবেনা পরিবার।একটা ঝামেলায় পড়ে গেল বাবা।হাইস্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম লাশ্রীতাসু সম্পর্কে জানে।তাই স্কুলের আঙ্গিনায় তাকে ঘুরতে দেখে প্রধান শিক্ষকের কাছে আবেদন করে ভর্তি করিয়ে দেয় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে(২০১১)। বাড়ি এসে বাবা মাকে সুসংবাদটি জানালো।এতে সবাই খুশি হল।শুরু হল লাশ্রীতাসু এর হাইস্কুল জীবণ।অধ্যায়ন করতে লাগল বিনা বেতনে।এভাবে সে যথাক্রমে ৭ম(২০১২) ও ৮ম(২০১৩) শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করলো।নিয়মিত নামাজ আদায় করে।ক্লাসের সবাইকে সে নামাজের দাওয়াত দেয়।অমুসলিম বন্ধুদের প্রতি খুব যত্নশীল।প্রতিদিন তাদের খোঁজ খবর নেয়। JSC পরীক্ষায় সে GPA 5.00 (A+)পেল। চারিদিকে সে খবরটি বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পরল।পাশের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিল মাস্টার তাকে অনুপ্রেরণা দিতে লাগল বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু লাশ্রীতাসু যে বিদ্যালয়ে পড়ে সেখানে কোন বিজ্ঞান শাখা নেই।তাই অন্য একটি বিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিল যেখানে বিজ্ঞান শাখা রয়েছে। সেখানেও ভর্তির জন্য সাহায্য করল খলিল মাস্টার।শুরু হল নবম শ্রেণীতে অধ্যায়ন(২০১৪)।লেখা পড়ার খরচ বাড়ি থেকে দিতে পারেনা।তাই সে টিউশনী খৌঁজতে থাকে।পাশেই ছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যাল।যার প্রধান শিক্ষক আব্দুস সাত্তার।সম্পর্কে নানা হয়। লাশ্রীতাসু তার সব বিষয় খোলে বলল উনার কাছে।তিনি বলে দিলেন যেন চতুর্থ শ্রেণীর সকল ছাত্র/ছাত্রী লাশ্রীতাসু এর নিকট প্রাইভেট পড়ে। টিউশনীর টাকা দিয়ে তার সকল খরচ ও লেখা পড়া চলতে লাগল।দু'বছর পেরিয়ে এল SSC পরীক্ষা(২০১৫)। পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না আসলেও একটি সরকারী কলেজে ভর্তি হতে পারল সে। আশাহত জীবণ এখন সম্ভাবনাময় জমিতে পরিণত হয়েছে।তার দু'চোখে শুধু সুদূর প্রসারী স্বপ্ন।তবে অর্থের অভাব ঘুচেনি।স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানায় সে। লেখকঃ মনির হোসাইন গ্রামঃ লামাকাটা পোঃ শ্রীপুর উপজেলাঃ তাহিরপুর জেলাঃ সুনামগঞ্জ

No comments:

সুনামগঞ্জের সর্ববৃহৎ সামাজিক অনলাইন প্লাটফর্ম 'সুনামগঞ্জ ডটকম'

আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ, পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের একটি অন্যতম জেলা সুনামগঞ্জ এবং তার মাটি ও মানুষ। অন্যদের মত স...